তোমাকে নিয়ে কেউ না হাসলে তোমার মধ্যে জিদ আসবেনা

ভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্নটা দেখা শুরু করেছিলাম ক্লাস নাইন থেকেই । আর ক্লাসের ফার্স্ট বয় থাকার দরুন সেই স্বপ্নটাকে আরো বেশি করে বড় করতে লাগলাম । ২০১৩ সালে যখন আমি ক্লাস টেন এ পড়ি তখন আমার বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই । সেই থেকে আমার চেষ্টা আর লক্ষ্য আরো কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল । কিন্তু জীবনের প্রথম বিপর্যয় ঘটলো এস.এস.সি পরীক্ষার রেজাল্টে এসে । যেখানে স্যারেদের হিসাব অনুযায়ী সবাই এ প্লাস পেল, এ প্লাস পেলনা শুধুমাত্র ক্লাসের ফার্স্ট বয়টা । ৪.৭৫ রেজাল্ট দেখে জীবনে সবচেয়ে বেশি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম ওই দিন । ওই কষ্টটা আজো আমাকে পীড়া দেয় । 

গ্রামের ছেলে আমি । উচ্চ মাধ্যমিক ভর্তি হই যশোরে । গ্রাম ছেড়ে ওটাই প্রথম শহরে যাওয়া । ক্লাসে এ প্লাস পাওয়া স্টুডেন্টস এর অভাব ছিলনা । নিজের সেরাটা দিয়ে কলেজ লাইফেও ২য় স্থান ধরে রাখলাম । আবারো স্বপ্ন দেখলাম এস.এস.সি তে তো এ প্লাস হলোনা, এবার নিশ্চয় হবে । কিন্তু এবারের রেজাল্ট আরো খারাপ হলো । ৪.৫০! তবে সেদিন আর কাঁদিনি । নিজেকে বুঝিয়েছিলাম এই ভেবে যে আমার ভাইয়া যদি কোনোটাতেই এ প্লাস না পেয়ে ঢাবিতে চান্স পায় তবে আমি কেন পাবোনা ? কিন্তু আমার কপাল! শুধু স্কুল, কলেজ আর কোচিং এর এক্সাম গুলাতেই ভালো রেজাল্ট করতাম! সব সময় টপে থাকতাম কিন্তু জায়গায় গিয়ে আর কিছুই পারতাম না । 

২০১৬ সালের ৭ই অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল । রেজাল্ট ফেইল আসলো । পরিবারের সব স্বপ্ন ওখানেই ভেঙে চুরমার গেল । সেদিন আব্বু, আম্মু আর ভাইয়ার চোখে আমি যে কষ্ট দেখেছিলাম তা কেবল আমিই বুঝেছিলাম । এরপর রাবি, ববি, ইবি সব জায়গায় বড় জোর ওয়েটিং পর্যন্তই যেতে পারলাম । কিন্তু সাব্জেক্ট আর পেলাম না । ভার্সিটি পড়ার স্বপ্ন বুঝি ওখানেই শেষ হয়ে গেল! অনিচ্ছা সত্ত্বেও NU তে ভর্তি হলাম হিসাববিজ্ঞান এ । কিন্তু ক্লাসে যেতাম না । কিন্তু চান্স পাবার আগেই আমি ভর্তি ক্যান্সেল করে দিসিলাম কারণ আমার বিশ্বাস ছিল আমি পারবোই, আমাকে পারতেই হবে । হয় পড়াশোনা ছেড়ে দিব আর নয়তো ভার্সিটি পড়বো । তো এরপর থেকে অনেক কথাও শুনতে হয়েছে । সবাই ভয় দেখাতো "যদি না হয়? এত সাহস ভালো না।" আমি শুধু সবার কথা শুনে যেতাম । সেকেন্ড টাইমার হিসাবে নিজেকে পরিচয় দিতেও খুব খারাপ লাগতো । কান্না পেত খুব । নীরবে কেঁদেছি ও অনেক । আমার পরিবারের সবার ইচ্ছা ছিল বিবিএ করার কিন্তু ঢাবিতে সেকেন্ড টাইম অফ করার পর আমার মন ভেঙে যায় । 

শুরু করি আর্টস এর কোচিং । বাংলা, ইংরেজি আর সাধারণ জ্ঞানের প্রিপারেশন নিই কারণ আমার ছেলেবেলা থেকেই শখ ছিল ইংরেজি/আইন নিয়ে পড়ার । কিন্তু এর পাশাপাশি নিজে নিজে বিবিএ এর পড়াও পড়তাম একটু আধটু । কিন্তু বেশি এফোর্ট ছিল বাংলা, ইংরেজি সাধারণ জ্ঞান এর উপর । মনের কষ্টে ২য় বার আমি কোনো কোচিং করিনি তবে শ্রদ্ধেয় ফারুক স্যারের ব্যাচে পড়তাম এবং নিয়মিত ক্লাস করতাম ও এক্সাম গুলা দিতাম । ওখানে আমি বরাবরই খারাপ রেজাল্ট করতাম । যতটুকু মনে পড়ে হাতে গোনা ৬ টা এক্সামে শুধু ভালো রেজাল্ট করতে পেরেছি তাও আবার ১০০ তে সর্বোচ্চ ৭৭ পাইছিলাম একদিন । আমার অন্যান্য বন্ধুরা সব সময় ৯০+ মার্ক্স পেত আর আমি কোনোরকম ৬০+ মার্ক্স পেতাম । তবু আমার কেন জানি এই আত্নবিশ্বাস ছিল যে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাবার জন্য এই ৬০ ই যথেষ্ট । এরপর একদিন খবর পেলাম রাবিতে সেকেন্ড টাইম দেওয়া যাবে । ওইদিন থেকে একটু বেশিই পড়তাম । ও হ্যাঁ! আমার একটা বদ অভ্যাস ছিল । আমি এত চাপের মধ্যেও দুইটা টিউশানি করতাম আর পড়তে বসতাম রাত ১১ টার দিকে । আর পড়তাম ফজরের আযান পর্যন্ত । মনে পড়েনা যে সন্ধ্যা থেকেই কখনো পড়ছি কিনা কারণ চারপাশে যখন নিঃশব্দ থাকতো তখন আমার পড়াটা খুব ভালো হতো । অনেকে হাসাহাসি করতো আমার এই পড়ার সময়টা নিয়ে । যখন আমি বলতাম তবুও স্বপ্ন দেখি ইংরেজি/আইন নিয়ে অনার্স করার তখন ও অনেকে হাসতো । সব সহ্য করতাম যে সময় এলে প্রমাণ করবো । আমার স্যার একদিন দারুন একটা কথা বলেছিলেন যে "তোমাকে নিয়ে কেউ না হাসলে তোমার মধ্যে জিদ আসবেনা, তুমি বড় কিছু করতে পারবেনা। " স্যারের কথাটা খুব ভালো লাগছিল । এরপর শুরু হলো ভর্তি পরীক্ষা । 

প্রথম পরীক্ষা জাবিতে । ১ম ভর্তি পরীক্ষাতেই সুসংবাদ পেলাম । সি ইউনিটে পজিশন আসলো ১২৬ । ওইদিন আমি আব্বু, আম্মু আর ভাইয়ার চোখে যে খুশি দেখেছিলাম তাতে আমার সব কষ্ট ঘুচে গেল । আমি সব জায়গাতেই পরীক্ষা দিয়েছিলাম কারণ ঢাবির পর আমার সব স্বপ্ন জুড়ে ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় । খুবির পরীক্ষা ছিল সব শেষে । এজন্য আগের পরীক্ষা গুলো সব দিলাম । আল্লাহর রহমতে কোথা থেকেও খালি হাতে ফিরতে হয়নি আমাকে ।
রাবি- এ-৪৮, ই-২৯৪
পাবিপ্রবি- সি ২৮০
বশেমুরবিপ্রবি- ডি- ২০
এবং প্রাণের খুবিতে ৫৭ তম স্থান অধিকার করলাম । আজ আমি সার্থক । লাইফে অনেক কষ্ট করেছি, বঞ্চিত হয়েছি অনেক কিছু থেকেই কিন্তু সেই কষ্ট গুলোকে আজ কোনো কষ্টই মনে হচ্ছেনা । আসলে একটা কথা আছে, কষ্ট করলে আল্লাহ তার ফল দেনই ।

أحدث أقدم