লজ্জার ভয় করো জয়

“করিতে পারিনা কাজ,

সদা ভয় – সদা লাজ,

সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,

পাছে লোকে কিছু বলে।”

-কামিনী রায়

সেই কতো বছর আগের কবিতা, এতদিনেও কি তার আবেদন এতটুকু কমেছে? বরং দিনদিন আরো বেড়ে চলেছে! ক্লাসে প্রশ্ন করতে লজ্জা, অপরিচিত মানুষের সাথে আলাপ করতে লজ্জা, সবার সামনে উপস্থাপন করতে লজ্জা – কতোরকম লজ্জা আমাদের সবার জীবনে! লজ্জার হরেক রকমফের আছে- কারো চামড়া গণ্ডারের মতো মোটা লাজশরমের বালাই নেই একদম, কেউ আবার সামান্য কিছুতেই লাজুকলতার মতো গুটিয়ে যায়! মানুষে মানুষে এমন বৈচিত্র্যের মাঝেও লজ্জার অনুভূতির কারণগুলোকে মোটামুটি পাঁচটি ভাগে ফেলা যায়।

১. ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন

আমাদের একান্ত অনেকগুলো অভ্যাস বা বৈশিষ্ট্য থাকে সেগুলো আমরা পৃথিবীর কাউকে জানাতে চাই না। কেউ আছে একাকী বেশ গুনগুন সুরে গান করে, কিন্তু মানুষের সামনে তার পেটে বোমা মেরেও এক লাইন গান বের করা যাবে না! আবার কেউ হয়তো অনেক বড় একজন মানুষ কিন্তু চোখের সামনে মানুষজন না থাকলে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় কাজ গভীর মনোযোগ দিয়ে নাকের লোম টেনে টেনে ছেঁড়া। সবারই এমন নানারকম বৈশিষ্ট্য থাকে, সেটি খুব তুচ্ছ কিছু হতে পারে কিন্তু পৃথিবীর কেউ তা জেনে যাবে ভাবলে মনে হয় লজ্জায় মরে যাই!

২. “জানি না” বলতে ভয়

কোনকিছু না জানা কখনোই দোষের কিছু নয়, লজ্জার তো নয় বটেই। তবু সোজাসাপ্টা “জানি না” বলতে কোন এক বিচিত্র কারণে আমাদের ভীষণ আপত্তি। ইন্টার্ভিউ বোর্ডে যেমন হরহামেশাই দেখা যায়- একটি প্রশ্নের উত্তর জানা না থাকলেও প্রার্থী সেটি স্বীকার করবে না, ভুরু কুঁচকে আঙুল কামড়ে বিড়বিড় করে “কী যেন..কী যেন..” অস্ফুট শব্দ করবে, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখে অসম্ভব চিন্তিত একটি ভাব ধরে রাখবে যেন তার মাথার ভেতর চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, যেন উত্তরটি তার মাথার ভেতর গড়াগড়ি খাচ্ছে একটু ঝাঁকুনি দিলেই জিবের ডগায় এসে পড়বে! অথচ একটি জিনিস না জানলে শুরুতেই তা বলে দিলে দু পক্ষেরই অনেকটুকু মূল্যবান সময় বেঁচে যায়!

৩. কিংকর্তব্যবিমূঢ়!

কিছু কিছু মুহূর্ত আছে যখন প্রকৃতি যেন একদম প্ল্যান করে উদ্ভট একটি কিছু ঘটায় এবং তখন লজ্জায় লাল হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। এক বন্ধু খুব মাঞ্জা মেরে গিয়েছে ডেটিংয়ে, বেশি টাইট প্যান্ট পরেছে চাপাচাপিতে কখন যেন সেটি জায়গামতো ফেঁসে গিয়েছে! খাওয়া শেষ, বিল দেওয়াও শেষ কিন্তু বেচারা তো জায়গা ছেড়ে উঠতেই পারছে না। রাস্তায় কলার খোসায় পিছলা খেয়ে পড়া, মাথায় উপর কাকের টয়লেট সেরে দেওয়া এগুলো তো সে তুলনায় অনেক সহজ পরিস্থিতি!

৪. সমালোচনা আর প্রত্যাখ্যানের ভয়

সবসময় কিছু মানুষ থাকে- তারা একটি কাজ করতে গেলে ইচ্ছে করে একটু খারাপ করবে এবং তারপর অনেকটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলবে, “আরে এখন তো একদম যেনতেন ভাবে করেছি, যত্ন নিয়ে করলে এর থেকে একশগুণ ভাল করতে পারতাম আমি!”

প্রশ্ন হচ্ছে, তাই যদি হতো তাহলে কেন প্রথমেই যত্ন নিয়ে করেনি কাজটা?! আসলে মানুষটি সমালোচনাকে ভীষণ ভয় পায় তাই সবার সামনে “এখন তো ইচ্ছে করে যাচ্ছেতাইভাবে করেছি!” এমন একটি অলীক ধারণা দিয়ে রাখে যেন কেউ তাকে কিছু বলতে না আসে।

আর প্রত্যাখ্যান? সে কথা আর নাই বলি! তুমি নিজেই একটু চিন্তা করলে হাজারটা উদাহরণ মনে করতে পারবে যেখানে তুমি একটা কিছু শুরু করার আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছ এই ভেবে- “চেষ্টা করে লাভ নেই, কাজ হবে না!” 

৫. “তাল মিলিয়ে” চলতে না পারা

“তোমার কাজিন তো কী সুন্দর ফর্সা! তুমি এত কালো কেন?”

“সেবার দেখলাম কী সুন্দর স্লিম ছিলে, এই কয়দিনে অনেক মোটা হয়ে গেছো দেখছি!”

“পাশের বাসার ছেলেটা তো ঠিকই গোল্ডেন পেল। তুমি পেলে না কেন? ও যেই চালের ভাত খায় তোমাকে কি অন্য চালের ভাত খাওয়াই?”

“ও তো আইফোন সেভেন কিনে ফেলেছে। তুই এখনো ফকিন্নি এই সেট ক্যামনে চালাস!”

জীবনে চলার পথে এমন অসম্ভব বিশ্রি নানা পদের কথা শুনতে হয় মানুষের থেকে। সমাজের বাঁধাধরা কদাকার একটি স্ট্যান্ডার্ড আছে- অনেক সফল হতে হবে, লম্বা ফর্সা সুন্দর হতে হবে, কোটি কোটি টাকা থাকতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি.. এগুলো থেকে একটু এদিক ওদিক হলেই চারদিক থেকে ছুটে আসবে নানারকম হুল ফুটানো কথার বাণ।

এই কারণগুলোর সবগুলোই যে তোমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা কিন্তু নয়, কিন্তু এই অনুভূতিগুলো পুরোপুরি এড়ানোও কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু সত্যিই কি লজ্জা পেয়ে গুটিয়ে নিতে হবে নিজেকে? কখনোই না! চলো, দেখে নেওয়া যাক লজ্জা কাটিয়ে আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে উঠতে পারবে কীভাবে।

বেড়িয়ে এসো নিজের খোলস থেকে!

“স্পটলাইট ইফেক্ট” বলে কিছু নেই

সেই যে তুমি ক্লাসে একটি ভুল উত্তর দিয়েছিলে দেখে সবাই হেসেছিল- আমি বাজি ধরে বলতে পারি দুইদিন পর কারো মনে থাকবে না সেই ঘটনাটি। রাস্তায় পিছলা খেয়ে পড়ে যখন তোমার লজ্জায় চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে- বিশ্বাস করো কারো এত সময় নেই তোমার অবস্থা দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসার। আমাদের সাথে একটি লজ্জার ঘটনা ঘটলে মনে হয় যেন আমরা সার্কাসের একটি জীব, আমাদের মাথার উপর একটি চোখ ধাঁধানো স্পট লাইট, চারপাশে হাজার হাজার মানুষ আমাদের সেই লজ্জার বিষয়টি দেখে আনন্দে দাঁত বের করে হাসছে!

তিক্ত কোন স্মৃতি থাকলে সেটিকে আজই মন থেকে মুছে ফেলো

অথচ বাস্তবে পৃথিবীর কারো খেয়েদেয়ে এত সময় নেই যে তোমার ভুলটি নিয়ে হেসে কুটোপুটি হবে। মানুষ নিজেকে নিয়েই অসম্ভব ব্যস্ত থাকে, আরেকজন কী ভুল করেছে না করেছে সেটি দেখার সময় কোথায়? আর যদি কেউ হাসেই, সেটাকে পাত্তা দেওয়ার কী আছে? তুমি যতবার গা ঝাড়া দিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, ততোবার ঐ গা জ্বালানো হাসি দেওয়া মানুষগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।

মাথা ঠাণ্ডা তো দুনিয়া ঠাণ্ডা

মঞ্চে অপূর্ব নৃত্য পরিবেশন করেন যে শিল্পীরা- সবসময় কি নাচের মুদ্রা সব ঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়? ভুলচুক হতেই পারে, কিন্তু সত্যিকারের পাকা শিল্পী সেই ভুলটিকেও এমন সুচারুভাবে খাপ খাইয়ে নেন উপস্থাপনায় যে খালি চোখে দর্শক বুঝতেই পারবে না পরিবেশনায় কোথাও গড়বড় ছিলো!

লজ্জা পাওয়ার মতো যদি কিছু ঘটেও যায়, সেটি নিয়ে চোখমুখ লাল না করে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে কী করলে পরিত্রাণ মিলবে এ পরিস্থিতি থেকে। সমস্যা থাকলে তার সমাধান অবশ্যই থাকবে! (ছোট্ট একটু বুদ্ধির পরীক্ষা হয়ে যাক। একটু মাথা খাটিয়ে বলো দেখি, ডেটিংয়ে গিয়ে প্যান্ট ফেঁসে যাওয়া সেই বন্ধু কীভাবে বুদ্ধি করে সেই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পেয়েছিল?)

হাসি? হেসেই উড়িয়ে দাও!

ঈশপের গল্পের সেই যে টেকো লোকটি পরচুলা মাথায় চেপে যাচ্ছিলো, হঠাৎ দমকা হাওয়ায় পরচুলা গেল উড়ে, সবাই তো কাণ্ড দেখে হেসে লুটোপুটি! টেকো মানুষটি রাগ করার বদলে একগাল হেসে বললো, “নিজের মাথার চুলই ধরে রাখতে পারলাম না, আর এ তো পরচুলা!”

লজ্জার কিছু ঘটলে সেটি নিয়ে অস্থির হওয়ার কিছু নেই, কেউ হাসলে তা নিয়ে রাগ করারও মানে হয় না, সবকিছু সহজভাবে নাও, কৌতুকের সাথে হেসেই নাহয় উড়িয়ে দাও ব্যাপারটি!

লজ্জার অভিজ্ঞতাটি মন থেকে ঝেড়ে ফেলো

তুমি যত সতর্ক মানুষই হও না কেন, লজ্জার কিছু অভিজ্ঞতা জীবনে ঘটবেই। সেগুলো নিয়ে ভেবে রাতের ঘুম নষ্ট করার কোন মানে হয় না। হয়তো কখনো ক্লাসে বোকার মত একটি প্রশ্ন করেছিলে দেখে সবাই হেসেছিলো। সেই স্মৃতি তোমার মনে সবসময় তাড়া করে ফেরে এবং তুমি ক্লাসে প্রশ্ন করাই বন্ধ করে দিলে। বড় হয়ে দেখা গেল স্মৃতিটি জট পাকিয়ে একটি জটিল পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যার ফলে তোমার এখন মানু্ষের সামনে কথা বলতেই ভয় হয়!

সুতরাং তিক্ত কোন স্মৃতি থাকলে সেটিকে আজই মন থেকে মুছে ফেলো। একটাই তো জীবন, তিক্ত স্মৃতিগুলো দিয়েই যদি ভরে থাকে হৃদয়, জীবনের সুন্দরতম অনুভূতিগুলো উপভোগ করবে কীভাবে?

ঘুরে দাঁড়াও, মুখোমুখি হও লজ্জার!

এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ লজ্জা তাড়ানোর। তোমার প্রেজেন্টেশন দিতে ভীষণ লজ্জা লাগে? এই ভয়টিকে কি সারাজীবন পুষে রাখবে বুকে নাকি বারবার প্রেজেন্টেশন দিয়ে ভয়টি চিরদিনের জন্য দূর করে দেবে মন থেকে? তুমি ইংরেজি ভাল পারো না, ইংরেজিতে কথা বলতে গেলে লজ্জায় মাথা কাটা যায়? আজ থেকেই প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে ইংলিশ স্পিকিং চর্চা শুরু করে দাও না কেন? 

লজ্জা মনে জন্ম নেয় একটি বীজ হিসেবে, চারপাশের মানুষের কটাক্ষ, মনের ভয়, পরিবেশ ইত্যাদির প্রভাবে সেটি বেড়ে চারাগাছে রূপ নেয়। তুমি যদি সময় থাকতেই লজ্জার কারণগুলো একদম গোড়া থেকে উপড়ে না ফেলো তাহলে সেটি একদিন মহীরুহে রূপ নিয়ে নেবে এবং তুমি প্রাণপণে চেষ্টা করেও তখন আর তা কাটিয়ে উঠতে পারবে না।

তাই কখনোই লজ্জাকে প্রশ্রয় দেয়া চলবে না। এই মুহূর্ত থেকেই ঘুরে দাঁড়াও নতুন আত্মবিশ্বাসে, সব সংশয় লাজ ঝেড়ে ফেলো মন থেকে। শুরু করেছিলাম কামিনী রায়ের কবিতা দিয়ে, শেষ করছি কালীপ্রসন্ন ঘোষের অমর সেই কবিতার মধ্য দিয়ে-

‘পারিবো না’–এ-কথাটি বলিও না আর,

কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার;

পাঁচজনে পারে যাহা,

তুমিও পারিবে তাহা,

পারো কি না পারো করো যতন আবার

এক বারে না-পারিলে দেখো শত বার।

أحدث أقدم